শুভ্র বেগ
বৃহত্তর ময়মনসিংহের গারো পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত নেত্রকোনা জেলার সুসং দুর্গাপুর। এই সুসং দুর্গাপুরে রয়েছে হাজং আদিবাসী সম্প্রদায়ের বসবাস। যুগ যুগ ধরে হাজং আদিবাসী সম্প্রদায় কৃষিকে একমাত্র পেশা হিসেবে বেছে নিলেও বর্তমানে তারা বিভিন্ন পেশার সাথে সম্পৃক্ত হচ্ছে। নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর উপজেলার সোমেশ্বরী নদীর তীরবর্তী বহেরাতলী গ্রামে এক কৃষিজীবী হাজং পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন জমিদার-মহাজন ও ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নারী নেত্রী কুমুদিনী হাজং। তাঁর জন্মসন সম্পর্কে সঠিক তথ্য তিনি নিজেও দিতে পারেননি। তাঁর পিতা ছিলেন বিখ্যাত ‘হাতিখেদা বিদ্রোহ’- এর অন্যতম বিদ্রোহী অতিথ চন্দ্র এবং মা জনুমনি হাজং।
জন্মের দুই বছর পরেই বাবা মায়ের মৃত্যু হলে মামার কোলেপিঠে বড় হন কুমুদিনী হাজং। ছিল না কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। তাঁর স্বামী হলেন টংক আন্দোলনের অন্যতম নেতা লংকেশ্বর হাজং।
গারো পাহাড়ি অঞ্চলের জমিদার-মহাজনদের আরোপিত টংক প্রথার শর্ত ছিল জমিতে ফসল হোক বা না হোক চুক্তিনুসারে টংকের ধান জমিদার-মহাজনদের দিতেই হবে। মূলত পাহাড়ি হাজং সম্প্রদায়ের শ্রমের ফলে উৎপাদিত ফসল ছিনিয়ে নেয়ার ফাঁদ ছিল এই টংক প্রথা।
১৯৩৭ সাল থেকে সুসং দুর্গাপুরের অন্যতম রত্ন সুসং জমিদারদের ভাগ্নে কমিউনিস্ট নেতা কমরেড মণি সিংহ এই টংক প্রথা ও জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের জন্য আন্দোলন শুরু করেন। এই আন্দোলনে হাজংদের সক্রিয় অংশগ্রহণ বাড়াতে কাজ করেন বহেরাতলী গ্রামের কুমুদিনী হাজং এঁর স্বামী লংকেশ্বর হাজং এবং তাঁর তিন বড় ভাই রাজেন্দ্র হাজং,ইসলেশ্বর হাজং ও গজেন্দ্র হাজং। এই কারণে তাঁরা জমিদার ও ব্রিটিশদের তীব্র ক্ষোভের মুখে পড়েছিলেন।
১৯৪৬ সালের ৩১ জানুয়ারি সকালবেলা ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেল বাহিনীর একটি দল বহেরাতলী গ্রামের লংকেশ্বর হাজং এঁর বাড়িতে হানা দেয়। হামলার খবর আগে থেকেই টের পাওয়ায় লংকেশ্বর হাজং ও তাঁর বড় ভাইয়েরা আত্মগোপনে যান পাশ্ববর্তী গ্রাম আড়াপাড়াতে কমরেড মণি সিংহের গোপন আস্তানায়।কুমুদিনী হাজং এর কাছে তাদের অবস্থান জানতে চাইলে তিনি বলে দেন ” জানিনা “। তাদেরকে বাড়িতে খুঁজে না পেয়ে সশস্ত্র সেনারা ক্ষিপ্ত হয়ে কুমুদিনী হাজংকে টেনেহিঁচড়ে বিরিশিরি ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যেতে উদ্যত হলে খবর পৌঁছে যায় রাশিমনি হাজং এঁর কাছে।তাঁর নেতৃত্বে ১২ জনের এক মহিলা সশস্ত্র দল কুমুদিনী হাজংকে ছাড়িয়ে নিতে গেলে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান টংক আন্দোলনের অন্যতম নারী নেত্রী হাজংমাতা কমরেড রাশিমনি হাজং। উদ্ধার হন কুমুদিনী হাজং। সংজ্ঞাহীন কুমুদিনী হাজংকে নিয়ে যাওয়া হয় মণি সিংহের গোপন আস্তানায় এবং ফিরে পান নিজের জীবন। পরবর্তীতে পুলিশের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য নাম পরিবর্তন করে রাখেন ” সরস্বতী।
গতকাল ২৩ মার্চ,২০২৪ বেলা ১ টা ৪০ মিনিটে টংক আন্দোলনের সর্বশেষ সাক্ষী এই মহান নারীনেত্রী ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে পরকালে পাড়ি জমিয়েছেন। তিনি ছিলেন টংক আন্দোলনের প্রেরণার উৎস। জীবিত অবস্থায় তিনি পাননি কোন রাষ্ট্রীয় খেতাব বা সম্মান। কিন্তু পেয়েছেন এই সুসং জনপদের অগণিত মানুষের সম্মান,শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা। সুসং গর্বের ধন কুমুদিনী হাজং-এঁর মৃত্যুতে তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক : শিক্ষক।
তথ্যসূত্র : ইন্টারনেট।